মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:২৫ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক :: এ যেন শস্যের মধ্যে ভূত। চিকিৎসা নিতে এসে পদে পদে হয়রানির আরেক নাম বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ, টপ টু বটম।
নামে জরুরি বিভাগ থাকলেও, সেখানে সেবা মেলে না। ঘুষ ছাড়া কোনো সেবাই না পাওয়ার কথা জানান রোগী ও স্বজনরা। তবে হাসপাতালটির চিত্র পরিবর্তনে পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে একজন সেনা কর্মকর্তাকে। তার অপেক্ষায় সবাই। সংবাদসূত্র: সময়টিভি।
হঠাৎ দেখলে মনে হতে পারে ঈদের ছুটিতে ট্রেন স্টেশন কিংবা লঞ্চ ঘাটের টিকিট কাটতে দীর্ঘ লাইন। কিন্তু তেমনটি নয়, এটি বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রতিদিনকার চিত্র।
একটু স্বাস্থ্যসেবা পেতে এখানে প্রতিদিনই রোগীদের মাঝে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। ঘটে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা। রোগীদের মাঝে রয়েছে অন্তহীন অভিযোগ এখানকার স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে। হাসপাতালটির আউটডোরে সেবা নিতে রোগীদের অভিযোগ, চিকিৎসা নিতে এলে এখানে উল্টো ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
বরিশাল নতুল্লাবাদ এলাকার আজিজুর রহমান। স্ত্রীর এক সপ্তাহ ধরে ঠান্ডা-কাশি। আড়াই ঘণ্টা লাইনের পর চিকিৎসক আজিজুল ইসলামকে দেখালে বেশকিছু পরীক্ষা দেন। হাসপাতালের প্যাথলজি ল্যাবে গেলে জানায়, পরীক্ষাগুলো বাইরে থেকে করাতে হবে।
লাগবে, অনেক টাকা। কিন্তু রোগীর সন্দেহ সামান্য জ্বর, কাশিতে এত পরীক্ষা? তাৎক্ষণিক, নতুন করে টিকিট কেটে একই হাসপাতালের মেডিসিনের আরেক চিকিৎসক ইসরাতকে দেখান।
তবে সেই চিকিৎসক কোনো পরীক্ষা না দিয়ে কেবল ওষুধ লিখে দেন। একই রোগে দুই রকম চিকিৎসায় ক্ষুব্ধ হয়ে চিকিৎসক আজিজুলের বিরুদ্ধে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ তোলেন রোগীর স্বজনরা।
ভুক্তভোগী সেবাগ্রহীতা আজিজুর রহমান বলেন, ‘গত সাতদিন ধরে আমার স্ত্রীর ঠান্ডা-জ্বর। ডাক্তার দেখাতে এসে চরম ভোগান্তিতে পড়ি। অনেক পরীক্ষা দেন চিকিৎসক। এসব পরীক্ষা দিয়ে চিকিৎসকরা মোটা অংকের কমিশন নেয়। সরকারি হাসপাতালে এসেও যদি ভোগান্তিতে পড়তে হয়, তাহলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে?
বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আউটডোর চিকিৎসক আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ঠান্ডা-জ্বর হলেও তার এই পরীক্ষাগুলো গুরুত্বপূর্ণ। আমি সরকারিভাবে পরীক্ষাগুলো করতে বলেছি। রোগী যদি এসব অভিযোগ দেয় তাহলে তো আমার কিছু বলার নাই।’
রোগীদের অভিযোগ, জরুরি বিভাগে প্রাথমিক চিকিৎসা পান না তারা। রোগী গেলে বেশিরভাগকেই ওয়ার্ডে ভর্তির নির্দেশ দেয়া হয়। তবে এনিয়ে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে চাননি দায়িত্বপ্রাপ্তরা।
আবুল নামে এক রোগী বলেন, ‘টিকিট কেটে এসে জরুরি বিভাগের ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি দিয়ে দেন। আমাকে একবার জিজ্ঞেস করলেন না আমার কী রোগ। শরীরের কী অবস্থা।
এখন যেখানে ভর্তি দিয়েছে সেখানে যাচ্ছি। জানি না সেখানে গিয়েও চিকিৎসক পাব কিনা। এমন হলেই সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে। আমি যে রোগ নিয়ে এসেছি সেখানে তো ভর্তি না দিলেও হয়তো হতো। কিন্তু ডাক্তার বলেছে এখন তো আর আমার কিছু করার নেই।’
জরুরি বিভাগ থেকে ওয়ার্ডে পাঠানো রোগীদের ট্রলি ব্যবহারের মধ্যদিয়ে শুরু হয় চরম ভোগান্তি আর টাকা লেনদেনের। শক্তিশালী সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে টাকা ছাড়া মিলে না ট্রলি।
এসব ট্রলি বহনকারীরা জানান, যে যেভাবে পারে খুশি হয়ে যা দেয় তাই নেই। যারা স্থায়ী চাকরি করে তারা কোনো দরকষাকষি করে না। তবে মাস্টার রোলে যারা আছে তারা হয়তো রোগীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। ট্রলি প্রতি ৫০/১শ’ সর্বোচ্চ ২শ’ যে যা দেয়, তাই খুশি হয় নেই।
অভিযোগ আছে, হাসপাতালের প্যাথলজিক্যাল বিভিন্ন বিভাগ কোনোটি মাস, কোনোটি বছরের পর বছর অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। বেসরকারি ডায়াগনস্টিক ল্যাবে পাঠাতে বাধ্য করা হয়। কমিশন ব্যবসায় জড়িত কতিপয় ডাক্তার ও স্টাফ। সময়ের ক্যামেরায়ও ধরা পড়ে এ নৈরাজ্য।
রোগী ও তাদের স্বজনরা বলেন, ‘সরকারিভাবে কোথাও পরীক্ষা চলে না। এক চক্র দালাল আছে যারা বাইরে পরীক্ষা করাতে নিয়ে যায়। ফলে চাইলেও আমাদের কিছু করার থাকে না। ডাক্তার দেখাতে এসে উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয় পদে পদে। যদি সরকারিভাবে পরীক্ষাগুলো করা যেত তাহলে অনেক টাকা সাশ্রয় হতো আমাদের।’
তবে হাসপাতালের পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা কর্মচারীরা বলেন, ‘গত তিন মাস ধরে এক্স-রে মেশিনের ফিল্ম নেই। ফলে আমরা এক্সরে করতে পারছি না। এছাড়া রোগীর চাপ বেশি থাকায় অনেক মেশিনেই সিরিয়াল বাধ্যবাধকতা আছে পরীক্ষায়। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, যাতে রোগীদের সেবা দিয়ে থাকতে পারি।’
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের একাধিক কর্মকর্তারা জানান, হাসপাতালে সামনে গড়ে ওঠায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর সঙ্গে শেয়ার ব্যবসা আছে, পরীক্ষাগারে কাজ করা কর্মচারীদের। ফোনে বছরের পর বছর হাসপাতালের মেশিনগুলো ফেলে রাখা হয় নষ্ট বলে।
আর এ সুযোগে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়, এসব কর্মচারী ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো যদি কঠোর হয়, তাহলে এ অনিয়ম ঠেকানো কোনো বিষয়ই না। আর হাসপাতালে যে কর্মচারীরা আছে, কাউকেই ছয় মাসের বেশি কাজ করতে দেয়া উচিত না। ছয় মাসের বেশি হলেই এরা নানা ধরনের সিন্ডিকেটের জড়িয়ে পড়ে। আর ভোগান্তিতে রাখে রোগীদের।
জনবল সংকট আর অতিরিক্ত রোগীর চাপে অব্যবস্থাপনা স্বীকার করে সমস্যা সমাধানে কাজ চলছে বলে জানান বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. এস এম মনিরুজ্জামান। তবে পরিবর্তনের ছোয়া লেগেছে হাসপাতালের খাবার ব্যবস্থায়। সংবাদ প্রকাশের পর পরিস্কার পরিছন্নভাবে রোগীদের জন্য তৈরি হচ্ছে খাবার।
কাগজে কলমে ৫শ’ বেডের হলেও গড়ে রোগী থাকে ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার অব্যবস্থাপনার পাহাড় তৈরি হয়েছে স্বীকার করে একজন সেনা কর্মকর্তাকে এই হাসপাতালের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জানিয়ে তার আগমনের মধ্য দিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত হবে বলে প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট সবার।